Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

শিরোনাম
ছিটমহলজুড়ে ক্ষোভের আগুন
বিস্তারিত

 

ছিটমহলবাসী কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছিটমহল বিনিময়ের ভূমিকাকে। বিজেপি ও মমতার ছিটমহল বিনিময় নিয়ে নেতিবাচক ভূমিকায় যারপরনাই ক্ষুব্ধ ছিটমহলবাসী। কয়েক দশক ধরে ছিটমহল বিনিময়ের জন্য আন্দোলন করে আসার পর এর একটা পথ খুলে যায় ২০১১ সালে। দুই দেশ রাজি হয়। সে বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় এই চুক্তি সম্পাদনের জন্য উভয় দেশই উদ্যোগ নেয়। প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। কিন্তু সফরের মাত্র দিন তিনেক আগে মমতা বাতিল করে দেন বাংলাদেশ সফর। আপত্তি তোলেন ছিটমহল বিনিময়ের বিরুদ্ধে। ফলে স্থগিত হয়ে যায় ছিটমহল বিনিময়ের প্রক্রিয়া। তবু তখন ছিটমহল বিনিময় নিয়ে উভয় দেশের মধ্যে একটি প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়।
বাংলাদেশ সরকার এই বিনিময়ের জন্য চুক্তি সম্পাদন করতে রাজি থাকলেও কিন্তু বাদ সাধেন ভারতের আসাম রাজ্যের দুই বিজেপি সাংসদ আর পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস। তৃণমূল নেত্রী মমতা জানিয়ে দেন, পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে কোনো বিনিময় নয়। ফলে মুখ থুবড়ে পড়ে ছিটমহল বিনিময়-প্রক্রিয়া। আর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ছিটমহলজুড়ে। দাবি উঠেছে, অবিলম্বে ছিটমহল বিনিময়ের। এদিকে মমতার একটি বক্তব্যকে খণ্ডন করেছেন ছিটমহলবাসী। মমতা কদিন আগে জানান, ছিটমহলবাসী চাইলে ছিটমহল বিনিময় হবে। অথচ কয়েক দশক ধরে এই বিনিময়ের দাবিতে ভারত ও বাংলাদেশের ছিটমহলবাসী আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁরা বিনিময়ের দাবিতে অবস্থান ধর্মঘট ও অনশন থেকে নানা আন্দোলনে শরিক হয়েছেন। অথচ নতুন কথা বলছেন মমতা?
কেমন আছেন ছিটমহলবাসী, সেই তথ্য জানার জন্য ১৮ আগস্ট চলে যাই পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার দিনহাটার বাত্রিগাছ ছিটমহলে। সেখান থেকে স্পষ্ট হয় ছিটমহলবাসীর মানবেতর জীবনযাপনের নানা চিত্র। ভারতের ভূখণ্ডে থাকা ৫১টি বাংলাদেশি ছিটমহলের হাজারো মানুষ এক মানবেতর জীবন যাপন করছে। তাঁরা নিজ দেশে পরবাসী হয়ে আছেন। তাঁরা বাংলাদেশের নাগরিক হলেও নাগরিকত্বের পরিচয় নেই। পারেন না সেই দেশের মৌলিক অধিকার ভোগ করতে। কোনো সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন না বাংলাদেশের। ভারতেরও সুযোগ-সুবিধা নিতে হয় তাঁদের বেনামে, আবার কখনো কখনো ঠিকানা বদলিয়ে।
বাত্রিগাছ ছিটমহলে বাস করছে বাংলাদেশের অন্তত ৫০০টি ছিটমহল পরিবার। ছিটমহলটিও দৈর্ঘ্যে তিন কিলোমিটার আর প্রস্থে পৌনে তিন কিলোমিটার। কথা বলেছি ছিটমহলবাসী আজাদ হোসেন, জয়নাল মিয়া, মোহাম্মদ আলী, বকুল মিয়া ও কল্পনাথ রায়ের সঙ্গে। তাঁরা জানান, দিনের পর দিন এভাবে বাঁচা যায় না। লুকোচুরি খেলে তো জীবনটা শেষ হয়ে গেল। এবার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে তাঁদের বেঁচে থাকার জন্য দিতে হবে ছিটমহল বিনিময়ের সুযোগ। তাঁরা আরও জানান, বাংলাদেশের নাগরিক হলেও তাঁদের বাংলাদেশের নাগরিকত্বের কোনো প্রমাণ নেই। এখন তাঁরা পরদেশে পরগাছা হিসেবে বাস করছেন। তাঁরা ছেলেমেয়েদের ভারতীয় বিদ্যালয়ে ভর্তি করছেন ছিটমহলের ঠিকানা বদলিয়ে, ভারতের কোনো ঠিকানা দিয়ে। হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন ভারতের ঠিকানা দিয়ে। সন্তান প্রসবের সময় মায়েদের ভারতের ঠিকানা দিয়ে ভর্তি হতে হচ্ছে হাসপাতালে। দিনমজুরের কাজ করতে হচ্ছে ভারতের এলাকায় ভুয়া ঠিকানা দিয়ে। তাই তাঁরা এই মানবেতর জীবনযাপন থেকে মুক্তি চান। বাস করতে চান একটি নির্দিষ্ট দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে। সুযোগ-সুবিধাও চান সেই দেশের। বাংলাদেশ তাঁদের গ্রহণ না করলে তাঁরা ভারতের মাটিতেই থাকতে চান। তাই তাঁরা দাবি তুলেছেন ছিটমহল বিনিময়ের। তাঁরা জানান, বাংলাদেশ সরকার ও ভারত সরকার রাজি হলেও ভারতের দু-একটি রাজনৈতিক দল রাজি হচ্ছে না। তাই তাঁরা আকুল আবেদন করেছেন ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছে। তাঁরা আরও জানান, এবার তাঁদের মুক্তি দেওয়া হোক এই মানবেতর জীবনযাপন থেকে। এসে দাঁড়াক ছিটমহল বিনিময়ের দাবির পাশে।
কথাও হয়েছে ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির সহসম্পাদক দীপ্তিমান সেনগুপ্তের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এই ছিটমহল বিনিময়ের দাবিতে দুই দেশেই আন্দোলন করছি। আমাদের দেশে যেমন বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল রয়েছে, তেমনি বাংলাদেশেও রয়েছে ভারতের ১১১টি ছিটমহল। আমরা চাইছি, ছিটমহলবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি ছিটমহল বিনিময় হোক। এতে ছিটমহলের বাসিন্দারা একটি নির্দিষ্ট দেশের নাগরিক হয়ে বাস করতে পারবে। সুযোগ পাবে সেই দেশের মৌলিক অধিকারের।’
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি ভারত ও বাংলাদেশের ভূখণ্ডে থাকা উভয় দেশের ১৬২টি ছিটমহল বিনিময়ের লক্ষ্যে সংবিধান সংশোধনী বিল ভারতের আইনসভার উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় পেশ করতে দেয়নি তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এতে ক্ষুব্ধ হয় ছিটমহলবাসী। জ্বলছে তাঁদের মনে ক্ষোভের আগুন। তাঁরা ক্ষুব্ধ হন মমতার বিরুদ্ধে। কয়েক যুগ ধরে উভয় দেশের ছিটমহলবাসী ছিটমহল বিনিময়ের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে এলেও, শেষ পর্যায়ে উভয় দেশ ছিটমহল বিনিময়ে রাজি হলেও, এখন আপত্তি তুলেছে পশ্চিমবঙ্গের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস ও আসামের বিজেপি।
ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির সহসম্পাদক জানান, ছিটমহল বিনিময়ের লক্ষ্যে সংবিধান সংশোধনী বিল যদি সংসদে না ওঠে, তবে তাঁরা মাঠে-ময়দানে লড়াইয়ের পাশাপাশি আইনি লড়াইয়ের পথে যাবেন। মামলা করবেন উচ্চ আদালতে।
এদিকে ছিটমহল বাসিন্দাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক অধিকারকে সুরক্ষিত করা এবং তাঁদের নাগরিকত্ব প্রদানের দাবিতে কলকাতা হাইকোর্টে গত সোমবার একটি জনস্বার্থ মামলা করেছেন বিশিষ্ট আইনজীবী অনির্বাণ দাস।
পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার ও জলপাইগুড়ি জেলার ভারতের ভূখণ্ডে রয়েছে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল। এর মধ্যে ৪৮টি কোচবিহার জেলায়। অন্যদিকে, বাংলাদেশের ভূখণ্ডে রয়েছে ভারতের ১১১টি ছিটমহল। ১৯১১ সালের ১৪ থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত অনুষ্ঠিত উভয় দেশের যৌথ জনগণনা অনুযায়ী, ভারতের ভূখণ্ডে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলে রয়েছে ১৪ হাজার ২১৫ জন বাংলাদেশির বাস। অন্যদিকে, বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ভারতের ১১১টি ছিটমহলে রয়েছে ৩৭ হাজার ৩৩৪ জন ভারতীয়র বাস। আইন মোতাবেক ভারতের ভূখণ্ডে বসবাসকারী ৫১টি ছিটমহলের বাসিন্দা বাংলাদেশি আর বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ১১১টি ছিটমহলে বসবাসকারীরা ভারতীয়। যদিও তারা উভয় নিজ নিজ দেশের কোনো সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারেন না।
ভারতের ভূখণ্ডে বাংলাদেশের ছিটমহলবাসী বাংলাদেশের নাগরিক হলেও কোনো সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন না বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে। নেই তাঁদের ভোটার পরিচয়পত্র। ছিটমহলবাসীর পরগাছা হিসেবে নিজেদের নাম-পরিচয় লুকিয়ে বাস করতে হচ্ছে ওই সব ভারতের ছিটমহলে। একই চিত্র বাংলাদেশে থাকা ভারতের ছিটমহলেও।
এবার সেই ছিটমহলবাসীর বেঁচে থাকার ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা প্রদান এবং নাগরিকত্ব প্রদানের দাবিতে কলকাতা হাইকোর্টে করা হয়েছে এই জনস্বার্থ মামলা। দাবি করা হয়েছে, ১৯৭৪ সালের ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি বলে অবস্থান অনুযায়ী নিজ নিজ দেশের নাগরিকত্ব প্রদানের।
অমর সাহা: প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি।

ছবি
ডাউনলোড